কোথা থেকে শুরু করা যায় এই কাহিনী? কাকে নিয়ে কথা বলা যায়? অনেক কিছু বলার আছে, যদিও সবকিছু ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যেমন দমকা বাতাস বা বৃষ্টি পরবর্তী সোনালি রোদ ভাষায় ধরা দেয় না, তেমনি রিয়াল মাদ্রিদের ১৫তম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জয়ের মাহাত্ম্যকেও যথাযথভাবে বর্ণনা করা কঠিন, এটি শুধু অনুভূত হতে পারে। যে সব বিশেষণ দিয়ে এটি বর্ণনা করা যায়, তা অনেক আগেই ব্যবহার হয়ে গেছে।
রিয়ালের চ্যাম্পিয়নস লিগের রূপকথা সম্পর্কিত গল্প অনেক আগে থেকেই পরিচিত। তবু বলতে হয়, এক প্রায় মৃতপ্রায় দলের পুনর্জাগরণের কথা। একজন ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের বড় মঞ্চে নায়ক হয়ে ওঠার গল্প। দানি কারাভাহালের গোল করার মুহূর্ত, যা বছর পাঁচেক পরে প্রথম ঘটলো, কে ভুলতে পারে সেই দৃশ্য?
রিয়ালের ছয়টি ইউরোপ সেরা শিরোপা জেতা চার তারকার কথা কে ভুলতে পারে? টনি ক্রুসের বিদায়ী গল্প যে ইতিহাস হয়ে গেছে! আর ডন কার্লো আনচেলত্তির অমরত্ব লাভের কথা বলতেই হবে। ওয়েম্বলিতে আজ রাতের তৈরি রূপকথা মূলত: ইউরোপিয়ান ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদ হচ্ছে শেষ কথা, এবং তাদের এই রাজত্ব চিরস্থায়ী।
রিয়াল মাদ্রিদের প্রত্যাবর্তনের কাহিনী: ডর্টমুন্ডের বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিত জয়
লন্ডনে ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদের ২-০ গোলের জয় প্রাথমিকভাবে তাদের জন্য নিদারুণ ছিল। প্রথমার্ধে দলটি নিজেদের খেলায় ছন্দ পায়নি। তবে রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকরা যারা দলের প্রতি গভীর আস্থা রাখেন, তারা বিশেষ চিন্তিত হননি। কারণ এসব অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি কোচ আনচেলত্তির কৌশলের অংশ বলে জানা। সেমিফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন এবং শেষ মুহূর্তের জয়ের পরিকল্পনা তার কৌশলেরই এক অংশ ছিল।
প্রথমার্ধে ডর্টমুন্ডের সাথে খেলা চলাকালীন, রিয়াল সমর্থকদের মনে পড়তে থাকে এসব কথা। দ্বিতীয়ার্ধে রিয়াল মাদ্রিদ ধীরে ধীরে নিজেদের খেলায় ফিরে আসে, বিশেষত টনি ক্রুসের ফ্রি-কিক প্রতিহত করে ডর্টমুন্ডের গোলরক্ষক যা খেলার গতিপথ পাল্টে দেয়। এরপর রিয়াল মাদ্রিদ ক্রুসের কর্নার থেকে দানি কারভাহালের অসাধারণ হেডে গোল করে ম্যাচে লিড নেয় এবং জয়লাভ করে।
রিয়ালের জয়ে ভিনিসিয়ুসের অবদান
রিয়াল মাদ্রিদের সাম্প্রতিক জয়ে ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের প্রভাব অপরিসীম। গোল করার পর তাঁর আত্মবিশ্বাস আকাশ ছুঁয়েছে। ম্যাচের প্রথমার্ধে যদিও ডর্টমুন্ডের ‘ক্রিসমাস ট্রি’ ফরমেশনে তাঁর পারফরম্যান্স কিছুটা থেমে গিয়েছিল, পরে তিনি তাঁর চিরাচরিত গতিতে ফিরে আসেন। ম্যাটস হামেলস এবং ইউলিয়ান রেয়ারসনের রক্ষণভাগে বাধা দেওয়ার চেষ্টাকে বারবার অগ্রাহ্য করেন ভিনি। ডর্টমুন্ডের এক ভুল তাঁকে আরেকবার গোল করার সুযোগ করে দেয়, যে গোল দ্বারা তিনি মার্কো রয়েসের বিদায়কে আরও মর্মান্তিক করে তোলেন।
ম্যাচ শেষে রিয়াল সমর্থকরা তাঁকে উষ্ণ অভিনন্দন জানান, এবং তিনি সমর্থকদের উদ্যাপনে সামিল হন। এ মুহূর্ত তাঁর জন্য নতুন নয়, কারণ তিনি আগেও ২০২২ সালে রিয়ালের চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জয়ে লিভারপুলের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করেছিলেন। এবারও তিনি টানা দ্বিতীয় ফাইনালে গোল করে তাঁর তারুণ্য ও দক্ষতার পরিচয় দেন।
রিয়াল তারকাদের জন্য ঐতিহাসিক ম্যাচ
ম্যাচটি রিয়ালের চার তারকা টনি ক্রুস, লুকা মদরিচ, দানি কারভাহাল এবং নাচোর জন্য বিশেষ ছিল। তারা রিয়ালের কিংবদন্তি পাকো হেন্তোর সাথে ইউরোপিয়ান সেরার ট্রফি সবচেয়ে বেশি বার জয়ের রেকর্ড ছুঁয়েছেন। পাকো হেন্তো ১৯৫৫-৫৬ থেকে ১৯৬৫-৬৬ মৌসুমের মধ্যে ৬ বার ইউরোপ সেরা হয়েছিলেন। আজকের শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে এই চারজন তার সঙ্গে সমতা সাধন করেছেন।
ক্রুসের জন্যও এই ফাইনাল অত্যন্ত বিশেষ ছিল। এই ম্যাচ দিয়ে তিনি রিয়াল মাদ্রিদ এবং ক্লাব ফুটবলকে বিদায় জানালেন। তার বিদায় বেলায় নিজের গুরুত্ব পুনরায় প্রমাণ করেছেন ক্রুস। প্রথমার্ধে তার ছন্দে না থাকায় রিয়াল সংগ্রাম করেছিল, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে তার স্বরূপে ফেরার পর রিয়াল আক্রমণাত্মক ভাবে ম্যাচে দাপট দেখানো শুরু করে। ভবিষ্যতে ক্রুসের অভাব রিয়াল নিশ্চিতভাবে অনুভব করবে। মার্কো রয়েসের হতাশা উল্লেখ করাও জরুরি। ডর্টমুন্ডের হয়ে তার শেষ ম্যাচটি খেলার পর তিনি হতাশা এবং শিরোপাহীন অবস্থায় ক্লাবকে বিদায় জানিয়েছেন।
বেলিংহামের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় এবং কোর্তোয়ার অসাধারণ প্রদর্শন
জুড বেলিংহাম রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে তার প্রথম মৌসুমেই চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে নিয়েছেন। তাঁর প্রথম সিজন দুর্দান্তভাবে শেষ হলেও, ফাইনালে তাঁর পারফরম্যান্স সেরা না হলেও, তা তাঁর উৎসবে যোগ দেওয়ার আনন্দে কোনো ব্যাঘাত ঘটায়নি। ম্যাচ শেষে একটি উচ্ছ্বাসিত মুহূর্তে বেলিংহাম বলেছেন, “এই ম্যাচের কথা আমি সর্বদা স্বপ্ন দেখেছি। আমার ভাই এখানে উপস্থিত ছিল এবং আমি সবসময় তার আদর্শ হতে চেয়েছি। এটা আমার জীবনের সেরা রাত ছিল।”
অন্যদিকে, থিবো কোর্তোয়া তাঁর গোলকিপিং দক্ষতা দিয়ে আবারও নিজেকে প্রমাণ করেছেন, যদিও সারা মৌসুম তিনি চোটের মুখে ছিলেন এবং বেলজিয়ামের ইউরো স্কোয়াডে জায়গা পাননি। মৌসুমজুড়ে যখন আন্দ্রেই লুনিন গোলকিপিং করার কথা শোনা যাচ্ছিল, তখন কোর্তোয়া নিজের পরীক্ষিত দক্ষতায় আস্থা রেখে আনচেলত্তির পছন্দ হয়ে ওঠেন। প্রথমার্ধে ডর্টমুন্ডের আক্রমণ মোকাবিলা করতে তিনি এক অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন।
আনচেলত্তির চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়: আকাশ ছোঁয়ার মুহূর্ত
শিরোপা অর্জনের পর, রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়রা যখন কোচ আনচেলত্তিকে আকাশে উচ্চে নিক্ষেপ করলো এবং তাকে ধরে ফেলল, মনে হচ্ছিল তিনি যেন সত্যিকারের আকাশে ভেসে যাচ্ছেন! যদিও মহাকর্ষ বল তাকে ধরে রাখল, তবে তিনি তার ডাগআউট থেকে সব পুরোনো রেকর্ড অতিক্রম করে গেছেন। তার মুখভঙ্গি এবং অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন না আনলেও, আজ রাতে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে তার অবস্থান ছিল সবার ঊর্ধ্বে। চুইংগাম চিবোতে চিবোতে তিনি রিয়ালকে তার ১৫তম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা এনে দিলেন, এবং নিজেকে বাকি প্রতিযোগীদের চেয়ে অনেক দূরে নিয়ে গেলেন।